টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে ব্রির পাঁচ দশক
ড. মো. শাহজাহান কবীর১, কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন২
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের ভিত্তি হচ্ছে কৃষি। আর বাংলাদেশে খাদ্যশস্য বলতে আমরা ধানকেই বুঝে থাকি। ধান এ দেশের মানুষের জীবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিভিন্ন ধান উৎপাদন মওসুম ও পরিবেশ উপযোগী আধুনিক ধান এবং লাগসই ধান উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বা ব্রি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশবাসীর খাদ্য চাহিদা পূরণ ও পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে তালমিলিয়ে ধানের ফলন, উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ব্রত নিয়ে এ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
বিগত পাঁচ দশকে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে অসামান্য অবদান রেখে চলছে ব্রি। অতীতের তীব্র খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ বর্তমানে উদীয়মান অর্থনীতির নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ি এখন শক্ত ভিত্তির উদ্বৃত্ত খাদ্যের বাংলাদেশ; ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃৃতীয় এবং গড় ফলনের হিসেবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম। স্বাধীনতার পর আমাদের জাতীয় জীবনে অন্যতম অসামান্য অর্জন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। এই অর্জনের পেছনে রয়েছে দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতি জাতির পিতার সুদূরপ্রসারী দিকনির্দেশনা, বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, ধান বিজ্ঞানীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং কৃষকের নিরলস পরিশ্রম। এই অসামান্য অর্জন সম্ভব হয়েছে প্রধানত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উচ্চফলনশীল ধানের জাত ও আনুষঙ্গিক লাগসই চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষকপর্যায়ে এসব প্রযুক্তির সফল প্রয়োগে।
১৯৭০-৭১ সালে দেশের ৭ কোটি ১২ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে চালের উৎপাদন ছিল এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন মাত্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে বলেছিলেন-‘দুনিয়া ভরে চেষ্টা করেও আমি চাউল কিনতে পারছি না। চাউল পাওয়া যায় না। যদি চাউল খেতে হয় আপনাদের চাউল পয়দা করে খেতে হবে।’এটা ছিল আমাদের বর্তমান সাফল্যের অনুপ্রেরণা বা দিকনির্দেশনা। সেই নির্দেশনাকে ধারণ করে ১৯৯৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃৃত্বে গঠিত ‘দিন বদলের সরকার’ সার এবং জ¦ালানি তেলের দাম কমানো, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, কৃষিতে প্রণোদনা প্রদান, সার বিতরণ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, দেশে হাইব্রিড ধানের প্রবর্তন, ব্রি ধান২৮, ২৯ এর ব্যাপক সম্প্রসারণ, ধানের উন্নতমানের বীজ সরবরাহ, সেচের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থাসহ ইত্যাদি নানামুখী কৃষকবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফলে ১৯৯৯ সালে দেশ প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রদান করা হয় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কর্তৃক মর্যাদাপূর্ণ সেরেস পদক। আবার ২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেন তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল ২৬ লাখ মেট্রিক টন। তাই সরকার গঠন করেই তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে। প্রথম ক্যাবিনেট সভায় সারের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। যেখানে ৮০ টাকার টিএসপির মূল্য ২২ টাকা ও ৭০ টাকার এমওপির মূল্য ১৫ টাকায় নামিয়ে এনে সুষম সার ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেন। এ ছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি প্রদান, ১০ টাকায় কৃষকের জন্য ব্যাংক হিসাব চালুকরণ, সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, কৃষিতে প্রণোদনা প্রদান, সার বিতরণ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিতে ২০১৩ সালে এসে দেশ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই অর্জন করেনি, খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়।
টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে বিভিন্ন ঘাতসহনশীল জাতসহ ব্রি এ পর্যন্ত ১০৬টি জাত উদ্ভাবন করেছে। খাদ্য নিরাপত্তাকে টেকসই করার জন্য স্থানভিত্তিক জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
গত ২০০৯-২১ পর্যন্ত তেরো বছরে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোর প্রতিটিই বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। যেমন- খরা, বন্যা, লবণসহিষ্ণু, জিংকসমৃদ্ধ, প্রিমিয়াম কোয়ালিটি, ডায়াবেটিক রাইসসহ অধিক উচ্চফলনশীল। পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় ব্রি এখন পর্যন্ত ১২টি লবণসহিষ্ণু, ৩টি খরাসহনশীল, ৩টি বন্যাসহনশীল, ২টি Tidal Submergence tolerant জাত ও ৩টি ঠাণ্ডাসহনশীল উদ্ভাবন করেছে। উচ্চতাপমাত্রা বা হিটশক ঝুঁকি এড়াতে উচ্চতাপমাত্রা সহনশীল একটি জাত ছাড়করণের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
ব্রি উদ্ভাবিত লবণাক্ততা সহনশীল জাতগুলো সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের মোট লবণাক্ত এলাকার প্রায় ৩৫ ভাগ ধান চাষের আওতায় এসেছে এবং এ থেকে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১২%। খরাপ্রবণ এলাকায় খরাসহিষ্ণু জাতগুলো সম্প্রসারণের মাধ্যমে ১২% আবাদ এলাকা বৃদ্ধি পেয়েছে যেখান থেকে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০%। জলমগ্নতা সহনশীল জাতগুলো সম্প্রসারণের মাধ্যমে ২৬% এলাকা চাষের আওতায় এসেছে যেখানে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৯%। উপকূলীয় এলাকায় ধানের আবাদ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে উদ্ভাবিত জোয়ার-ভাটাসহনশীল জাত (ব্রি ধান৭৬, ৭৭) সম্প্রসারণের ফলে প্রায় ৫৭০০০ হে. জমি এই ধান চাষের আওতায় এসেছে। সর্বোপরি, ২০১৮-১৯ সালে উচ্চফলনশীল ধানের জাতগুলো দেশের শতকরা ৮০ ভাগ জমিতে চাষ করা হয়েছে এবং এ থেকে পাওয়া গেছে দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯১ ভাগ। ঘাতসহনশীল ও অনুকূল পরিবেশ উপযোগী জাতগুলোর আবাদ সম্প্রসারণের ফলে ২০১০-১৯ পর্যন্ত ৬.০ লাখ টন হারে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) এবং বর্তমান সরকারের ভিশন ২০২১ এবং ২০৪১ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্রি ইতোমধ্যে Rice Vision -২০৫০ প্রণয়ন করেছে। রাইস ভিশন বাস্তবায়নের পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে ব্রি (Doubling Rice Productivity) নামে একটি স্ট্র্যাটেজিক প্লান তৈরি করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, উৎপাদনের গতিশীলতা অব্যাহত থাকলে চালের উৎপাদন ২০৩০ সালে ৪৬.৯, ২০৪০ সালে ৫৪.১ এবং ২০৫০ সালে ৬০.৯ মিলিয়ন টন এ উন্নীত হবে। ফলে আমরা ২০৩০ সালে ৪.২, ২০৪০ সালে ৫.৩ এবং ২০৫০ সালে ৬.৫ মিলিয়ন টন চালে উদ্বৃত্ত থাকব। মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশনায় আমরা পুষ্টি নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে কাজ করে যাচ্ছি। কেননা, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির অধিকাংশ ক্যালরি, প্রোটিন ও মিনারেল আসে ভাত থেকে। ভাত তাদের কাছে সহজলভ্য। সাধারণ মানুষ দুধ, ডিম ও মাংসসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার কিনতে না পারলেও ভাত নিয়মিত খেতে পারছে। তাই ভাতের মাধ্যমে কিভাবে পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করা যায় সেই লক্ষ্যে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। চাল ছেঁটে যাতে চালকে অনিরাপদ করতে না হয় সেজন্য ব্রি ইতোমধ্যে প্রিমিয়াম কোয়ালিটি সম্পন্ন জাত যেমন- ব্রি ধান৫০, ব্রি ধান৯০ প্রভৃতি উদ্ভাবন করেছে। এসডিজিকে সামনে রেখে ব্রি বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে ৬টি জিংকসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন করেছে, পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যেমন- প্রোটিন, আয়রন, এন্টি-অক্সিডেন্ট, গাবা ও বিটা ক্যারোটিনসমৃদ্ধ জাতসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর ধান উদ্ভাবন করেছে। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে জিংকসমৃদ্ধ জাত বঙ্গবন্ধু ধান১০০ অবমুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া শরীরের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদানগুলো দেহের প্রয়োজন অনুসারে চালে সংযোজন, সরবরাহ বা পরিমাণে বৃদ্ধি করে উদ্ভাবনকৃত জাতগুলো অবমুক্তকরণের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। চাল প্রক্রিয়াজাত করে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে কাজ করছে ব্রি।
গবেষণায় দেখা গেছে, যদি ১% প্রোটিনের পরিমাণ চালে বৃদ্ধি করা যায়, তবে মানব শরীরে ৬.৫% বেশি চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। ব্রি পুরানো ধানের জাতগুলোর প্রোটিনের মাত্রা ছিল মাত্র ৮ থেকে ৯% তবে নতুন জাতগুলোর প্রোটিনের পরিমাণ ৯ থেকে ১০%। ভবিষ্যতে ব্রি’র লক্ষ্য ১২-১৩% প্রোটিনসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন করা যাতে চাল থেকে প্রতিদিনের প্রোটিন চাহিদার কমপক্ষে ৮০% পূরণ সম্ভব হয়। আগে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোতে আয়রনের পরিমাণ ছিল ৩ থেকে ৫ পিপিএম। ব্রি ধান৮৪ তে আয়রনের পরিমাণ ১০ পিপিএম। ব্রির ‘হেলদিয়ার রাইস’গবেষণা কর্মসূচির অধীনে এখন ৪৫ পিপিএম জিংক এবং ১৫ পিপিএম আয়রন সমৃদ্ধ দ্বৈত সুবিধার নতুন জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা যাতে মানব শরীরের মোট চাহিদার কমপক্ষে ৮০% জিংক এবং ৫০% আয়রনের চাহিদা চালের মাধ্যমে পূরণ করা যায়।
এ ছাড়া আমরা জানি ভিটামিন-এ এর ঘাটতি এখনো বাংলাদেশের একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। দেশের প্রি-স্কুল এবং স্কুল-বয়সী শিশুদের ২০% এর বেশি এবং গ্রামাঞ্চলে ২৫% গর্ভবতী মহিলা ও স্তন্যদানকারী মা এই সমস্যায় ভোগেন। অবমুক্তির অপেক্ষায় থাকা ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ধান গোল্ডেন রাইস আমাদের এই সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখবে। আশা করা যাচ্ছে, গোল্ডেন রাইস অনুমোদিত ও অবমুক্ত হলে ভিটামিন এ চাহিদার ৩০-৫০% পর্যন্ত পূরণ করতে পারবে।
আগামী ১ অক্টোবর ২০২১ ব্রির ৫০ বছরপূর্তি। আমরা দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ঘোষিত ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এসডিজি-২০৩০, ডেল্টা প্লান-২১০০সহ সকল মাইলফলক অর্জনে ব্রি অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে কাজ করে যাবে।
লেখক : ১মহাপরিচালক, ২ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। মোবাইল : ০১৭১৬৫৪০৩৮০
ই-মেইল :smmomin80@gmail.com